প্রশ্ন
ঈশ্বর কিংবা বাইবেল কি লৈঙ্গিকতা বা নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য বা ভেদাভেদ করে?
উত্তর
লৈঙ্গিকতা বা লিঙ্গবাদ হচ্ছে একটি বিশেষ্য বা সর্বনাম পদবাচক লিঙ্গ যা সচরাচর পুরুষকে বুঝিয়ে থাকে যারা অন্য লিঙ্গের উপর বিশেষ করে স্ত্রীলোকদের উপর কর্তৃত্ব করে। স্ত্রীলোকদের বিষয়ে বাইবেলে এমন অনেক ঘটনা রয়েছে যা আমাদের আধুনিক মন-মানসিকতা, তাদের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণমূলক বিষয়গুলোকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কিন্তু আমাদের এ কথা স্মরণে রাখতে হবে যে, বাইবেল যখন কোন কাজের কথা বর্ণনা করে তখন এটি অবশ্যই এই অর্থ প্রকাশ করে না যে, বাইবেল সেই বিষয়টি সমর্থন বা অনুমোদন করে। বাইবেলে স্ত্রীলোকদের পুরুষের তুলনায় অল্প পরিমাণে নীচু বা খাটো করে উপস্থাপন করা হয়েছে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ঈশ্বর ঐ বিষয়টি সমর্থন করেন। পবিত্র বাইবেল আমাদের সমাজ বা গোত্রগুলোর তুলনায় আমাদের আত্মার পুনর্গঠনের উপর অনেক বেশী আলোকপাত করে থাকে। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর জানেন যে, আমাদের অন্তর পরিবর্তীত হলে আমাদের আচার-ব্যবহারও পরিবর্তীত হবে।
পুরাতন নিয়মের সময়কালে সমগ্র বিশ্বের সকল কৃষ্টির সামাজিক কাঠামোর ধরন ছিল মূলত পিতৃতান্ত্রিক। ইতিহাসের এই যে অবস্থা তা খুবই স্পষ্টভাবে প্রতিভাত। এটি শুধু শাস্ত্রের বিষয় নয় কিন্তু তা কাউকে শাসন করার ক্ষেত্রে নিয়ম-কানুনের মধ্যেও বিরাজমান। আধুনিক মূল্যবোধ এবং বিশ্ব মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে এই বিষয়টিকে বলা হচ্ছে "লৈঙ্গিকতাবাদ" (নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য)। সমাজের মধ্যে শাসন বা কর্তৃত্ব সংক্রান্ত নীতিমালা কোন মানুষ নয়, কিন্তু স্বয়ং ঈশ্বরই প্রচলন করেছেন। কারণ তিনি হলেন এগুলো তৈরীর কারিগর। যাহোক, অন্য সব কিছুর মত পাপে পতিত মানুষ ঈশ্বরের এই আদেশও কলুষিত করলো। যার ফলে সমগ্র ইতিহাস জুড়ে নারী-পুরুষের মাঝে বৈষম্যের সৃষ্টি হলো। আজ আমাদের সমাজের মাঝে অন্যকে ত্যাগ বা বর্জন করা এবং পক্ষপাতমূলক বিষয় লক্ষ্য করি তা নতুন কোন বিষয় নয়। এটি মানুষের পাপে পতনের সময় থেকেই শুরু হয়ে আসছে। সে যাই হোক না কেন, আমরা নির্বিধায় বলতে পারি যে, "লৈঙ্গিকতা বা নারী-পুরুষ ভেদাভেদ"-এর বিষয়টি হচ্ছে আমাদের মন-মানসিকতার ধারনার ফল এবং এটির চর্চাই হচ্ছে পাপ। বাইবেলে উল্লেখিত শিক্ষাগুলো আমাদের এরূপ লৈঙ্গিকতা বা নারী-পুরুষের ভেদাভেদ তথা সমাজে বিদ্যমান এগুলোর চলমান অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের পরিচালনা দান করে।
ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের মাঝে ঈশ্বরের অবস্থান এবং আত্মিক অবস্থা খুঁজে পেতে কিংবা এগুলো সমাজের মধ্যে বজায় রাখতে আমাদের অবশ্যই শাস্ত্রমুখী হতে হবে। নতুন নিয়ম হচ্ছে পুরাতন নিয়মের পরিপূরক এবং আমরা শাস্ত্রের মধ্যে ঐ সব নিয়ম-কানুন খুঁজে পাই যা আমাদের বলে যে, নারী-পুরুষের বৈষ্যম্যের উপর ভর করেই ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের ব্যবহার প্রক্রিয়া, পাপ হতে মুক্তি লাভের উপায় এবং মানবগোষ্ঠীর অসুস্থতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় এবং এগুলো পক্ষপাতমূলক হয়ে ওঠে।
সমাজ তথা গোত্রের মধ্যে পারস্পরিক সমতা বজায় রাখার সবচেয়ে বড় মানদন্ড হচ্ছে খ্রীষ্টের ক্রশ। যোহন ৩:১৬ পদে লেখা আছে, "যে কেহ তাঁহাতে বিশ্বাস করে"- এটি এমন একটি বিবৃতি যা সমাজে বসবাসরত কাউকেই বাদ দেয়নি। তাছাড়া আমরা গালাতীয়দের কাছে লেখা প্রেরিত পৌলের পত্রের একটি অংশে দেখি যে, খ্রীষ্টের পরিত্রাণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সকলের সমান সুযোগ বা অধিকার রয়েছে। "কেননা তোমরা সকলে, খ্রীষ্ট যীশুতে বিশ্বাস দ্বারা, ঈশ্বরের পুত্র হইয়াছ; কারণ তোমরা যত লোক খ্রীষ্টের উদ্দেশ্যে বাপ্তাইজিত হইয়াছ, সকলে খ্রীষ্টকে পরিধান করিয়াছ। যিহূদী কি গ্রীক আর হইতে পারে না, দাস কি স্বাধীন আর হইতে পারে না, কেননা খ্রীষ্ট যীশুতে তোমরা সকলেই এক" (গালাতীয় ৩:২৬-২৮ পদ)। খ্রীষ্টের ক্রশের কাছে কোন ধরনের লৈঙ্গিকতা বা নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই।
পবিত্র বাইবেল নারী-পুরুষ ভেদাভেদে বিশ্বাসী নয় এবং পাপের যে শাস্তি তা নারী-পুরুষ সকলের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। বাইবেলে সব ধরনের পাপের কথা লিপিবদ্ধ আছে: দাসপ্রথা, দাসত্বের বন্ধন, এবং বিখ্যাত বীরদের ব্যর্থতাসমূহও এখানে লেখা আছে। এটি আমাদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেয় এবং ঈশ্বরের এবং তাঁর আদেশের বিরুদ্ধে করা পাপের প্রতিকার করে- যাতে ঈশ্বরের সাথে আমাদের সুন্দর একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পুরাতন নিয়মে সবচেয়ে ভাল বলী উৎসর্গ করার কথা বলা হয়েছে এবং পাপ কাজের জন্য প্রত্যেক বার বলী বা যজ্ঞ উৎসর্গ করা হয়েছে, এগুলোর মধ্য দিয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যেন আমরা পুনরায় ঈশ্বরের সাথে সম্পর্কিত হতে পারি।
নতুন নিয়মে লক্ষ্য করা যায় যে, "মেষশাবক যিনি জগতের পাপভার লইয়া যান" তিনি জন্মগ্রহণ করলেন, মারা গেলেন, কবরপ্রাপ্ত হলেন ও পুনরায় জীবিত হয়ে উঠলেন, তাঁর জন্য নির্ধারিত স্থান অর্থাৎ স্বর্গে আরোহণ করলেন এবং সেখান থেকে তিনি আমাদের পক্ষে মধ্যস্থতা করছেন। আমরা আমাদের নিজ নিজ পাপ থেকে তখনই প্রতিকার লাভ করি যখন আমরা তাঁকে বিশ্বাসে গ্রহণ করি। আমাদের পাপসমূহের মধ্যে নারী-পুরুষ ভেদাভেদজনিত পাপও জড়িত রয়েছে।
পবিত্র শাস্ত্র সম্পর্কিত জ্ঞানের স্বল্পতার কারণেই আমাদের মধ্যে বাইবেলে উল্লেখিত নারী-পুরুষ বৈষম্যজনিত সমস্যার উদ্ভব হয়। যখন সব বয়সের পুরুষ ও মহিলারা ঈশ্বর প্রদত্ত আদেশ গ্রহণ করে "ঈশ্বর যেভাবে বলেন" সেই মত জীবন যাপন করে তখন নারী-পুরুষ সকলের মাঝে একটি চমৎকার সমতা বিরাজ করে। এটি হলো সেই সমতা যা ঈশ্বর আদিতে শুরু করেছিলেন এবং এভাবে শেষও করবেন। আমাদের সব ধরনের পাপের জন্য পরিপূর্ণ মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। আমাদের মাঝে তখনই সত্যিকারের সমতা বিরাজ করে যখন আমরা প্রভু যীশু খ্রীষ্টের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সাথে পুনঃস্থাপিত হই। যোহন ৮:২২ পদে লেখা আছে, "আর তোমরা সেই সত্য জানিবে, এবং সেই সত্য তোমাদিগকে স্বাধীন করিবে।"
এই বিষয়টি বুঝতে পারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, নারী ও পুরুষের জন্য পবিত্র বাইবেল যে সব ভিন্ন ভিন্ন ধরনের নিয়ম-কানুনের কথা উল্লেখ করে তা কিন্তু নারী-পুরুষের মধ্যকার ভেদাভেদ বা বৈষম্যকে স্থাপন করে না। পবিত্র বাইবেল সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে যে, ঈশ্বর প্রত্যাশা করেন যেন পুরুষ লোকেরা মন্ডলী ও ঘর-বাড়ীতে কর্তৃত্বভার গ্রহণ করে। এই বিষয়টি কি স্ত্রীলোকদের খাটো বা নীচু করে? একেবারেই তেমনটি নয়। এর দ্বারা কি এটি বুঝায় যে, ঈশ্বরের চোখে স্ত্রীলোকেরা কম বুদ্ধিসম্পন্না, কোন কাজ করতে কম সক্ষম কিংবা তাদের খাটো করে দেখা হচ্ছে? একেবারেই তেমন কোন কিছু নয়! বরং এর দ্বারা আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের পাপে এই জগৎ ভরপুর। আর তা দূর করার জন্য একটি শক্ত কাঠামো ও দৃঢ় কর্তৃত্বের দরকার রয়েছে। প্রেমময় পিতা ঈশ্বর আমাদের সকলের ভালোর জন্যই এই জগতের মাঝে কর্তৃত্ব বা ক্ষমতাজনিত যাবতীয় নিয়ম-কানুন প্রদান করেছেন। আর নারী-পুরুষের মধ্যে ভেদাভেদ এই সব নিয়ম-কানুনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পথে বাধাস্বরূপ এবং এই ভেদাভেদ ঈশ্বর দত্ত নিয়ম-কানুনের অপব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নয়।
English
ঈশ্বর কিংবা বাইবেল কি লৈঙ্গিকতা বা নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য বা ভেদাভেদ করে?