প্রশ্ন
লূকলিখিত সুসমাচার
উত্তর
লেখকঃ লূকের লেখা সুসমাচারটি এর লেখকের পরিচয় প্রদান করে না। লূক ১:১-৪ ও প্রেরিত ১:১-৩ পদ হতে এটি স্পষ্ট যে, একই লেখক লূকলিখিত সুসমাচার ও প্রেরিত পুস্তক লিখেছেন যেখানে উভয়টিতেই “মহামহিম থিয়ফিল” বলে সম্বোধন করা হয়েছে, সম্ভবতঃ তিনি একজন উচ্চপদস্থ রোমীয় ব্যক্তি ছিলেন। মন্ডলীর প্রাথমিক দিনগুলোর ঐতিহ্য মতে লূক হলেন একজন ডাক্তার, প্রেরিত পৌলের খুব কাছের একজন সঙ্গী যিনি লূক সুসমাচার ও প্রেরিত পুস্তক লিখেছেন (কলসীয় ৪:১৪; ২তীমথিয় ৪:১১ পদ)। এটির দ্বারা স্পষ্ট যে, পরজাতীয় হিসেবে একমাত্র লূকই পবিত্র শাস্ত্রের যে কোন পুস্তক লিখতে পারেন।
লেখার সময়কালঃ লূকলিখিত সুসমাচারটি খুব সম্ভবতঃ ৫৮-৬৫ খ্রীষ্টাব্দ সময়ের মধ্যে লেখা হয়েছে।
লেখার উদ্দেশ্যঃ অন্য দু’টি সংক্ষিপ্ত সুখবরের সাথে সাথে মথি ও মার্কলিখিত সুসমাচার নামক পুস্তক দু’টির উদ্দেশ্য হলো প্রভু যীশু খ্রীষ্টকে এবং “যাহা যীশু সেই দিন পর্যন্ত সাধন করিতে ও শিক্ষা দিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, যে দিনে তিনি আপনার মনোনীত প্রেরিতদিগকে পবিত্র আত্মা দ্বারা আজ্ঞা দিয়া ঊর্ধ্বে নীত হইলেন” সেই সমস্ত বিষয় প্রকাশ করা (প্রেরিত ১:১-২ পদ)। লূকের লেখা সুসমাচারটি একটি “আনুপূর্বিক বিবরণ” (লূক ১:৩ পদ) সম্পর্কিত অতি সুবিবেচনাপ্রসূত পুস্তক যে লূকের চিকিৎসা সম্পর্কিত চিন্তাভাবনার সাথে সামঞ্জুস্যপূর্ণ যা প্রায়ই অন্যদের হিসাব বা বিবরণী ব্যতীত লিখিত। একজন মহান চিকিৎসকের জীবনীনির্ভর এই ইতিহাস যে বিষয়টির উপর সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব বা জোর প্রদান করে তা হলো- পরজাতি, শমরীয়, মহিলা, শিশু, কর-আদায়কারী, পাপী এবং যারা ইস্রায়েল জাতির মধ্যকার ভিন্ন গোত্রের প্রতি করুণা বা সহানুভূতি প্রদর্শন।
মূল বা প্রধান পদসমূহঃ লূক ২:৪-৭ পদ, “আর যোষেফও গালীলের নাসরৎ নগর হইতে যিহূদিয়ায় বৈৎলেহম নামক দায়ূদের নগরে গেলেন, কারণ তিনি দায়ূদের কুল ও গোষ্ঠীজাত ছিলেন; তিনি আপনার বাগ্দত্তা স্ত্রী মরিয়মের সহিত নাম লিখিয়া দিবার জন্য গেলেন; তখন ইনি গর্ভবতী ছিলেন। তাহারা ঐ স্থানে আছেন, এমন সময়ে মরিয়মের প্রসবকাল সম্পূর্ণ হইল। আর তিনি আপনার প্রথমজাত পুত্র প্রসব করিলেন, এবং তাঁহাকে কাপড়ে জড়াইয়া যাবপাত্রে শোয়াইয়া রাখিলেন, কারণ পাস্থশালায় তাহাদের জন্য স্থান ছিল না।”
লূক ৩:১৬ পদ, “যোহন উত্তর করিয়া সকলকে কহিলেন, আমি তোমাদিগকে জলে বাপ্তাইজ করিতেছি বটে, কিন্তু এমন এক জন আসিতেছেন, যিনি আমা অপেক্ষা শক্তিমান, যাঁহার পাদুকার বন্ধন খুলিবার যোগ্য আমি নই, তিনি তোমাদিগকে পবিত্র আত্মা ও অগ্নিতে বাপ্তাইজ করিবেন।”
লূক ৪:১৮-১৯; ২১ পদ, “প্রভুর আত্মা আমাতে অধিষ্ঠান করেন, কারণ তিনি আমাকে অভিষিক্ত করিয়াছেন, দরিদ্রদের কাছে সুসমাচার প্রচার করিবার জন্য; তিনি আমাকে প্রেরণ করিয়াছেন, বন্দিগণের কাছে মুক্তি প্রচার করিবার জন্য, অন্ধদের কাছে চক্ষুদান প্রচার করিবার জন্য, উপদ্রুতদিগকে নিস্তার করিয়া বিদায় করিবার জন্য, প্রভুর প্রসন্নতার বৎসর ঘোষণা করিবার জন্য; আর তিনি তাহাদিগকে বলিতে লাগিলেন, অদ্যই এই শাস্ত্রীয় বচন তোমাদের কর্ণগোচরে পূর্ণ হইল।”
লূক ১৮:৩১-৩৩ পদ, “পরে তিনি সেই বারো জনকে কাছে লইয়া তাহাদিগকে কহিলেন, দেখ, আমরা যিরূশালেমে যাইতেছি; আর ভাববাদিগণ দ্বারা যাহা যাহা লিখিত হইয়াছে, সেই সমস্ত মনুষ্যপুত্রে সিদ্ধ হইবে। কারণ তিনি পরজাতীয়দের হস্তে সমর্পিত হইবেন, এবং লোকেরা তাঁহাকে বিদ্রূপ করিবে, তাঁহাকে অপমান করিবে, তাঁহার গায়ে থুথু দিবে; এবং কোড়া প্রহার কিরয়া তাঁহাকে বধ করিবে; পরে তৃতীয় দিবসে তিনি পুনরায় উঠিবেন।”
লূক ২৩:৩৩-৩৪ পদ, “পরে মাথারখুলি নামক স্থানে গিয়া তাহারা তথায় তাঁহাকে এবং সেই দুই দুষ্কর্মকারীকে ক্রুশে দিল, এব জনকে তাঁহার দক্ষিণ পার্শ্বে ও অন্য জনকে বাম পার্শ্বে রাখিল। তখন যীশু কহিলেন, পিতঃ, ইহাদিগকে ক্ষমা কর, কেননা ইহারা কি করিতেছে, তাহা জানে না।”
লূক ২৪:১-৩ পদ, “সপ্তাহের প্রথম দিন অতি প্রত্যুষে তাহারা [মহিলারা] কবরের নিকটে আসিলেন, যে সুগন্ধি দ্রব্য প্রস্তুত করিয়াছিলেন, তাহা লইয়া আসিলেন; আর দেখিলেন, কবর হইতে প্রস্তরখানা সরান গিয়াছে, কিন্তু ভিতরে গিয়া প্রভু যীশুর দেহ দেখিতে পাইলেন না।
সারসংক্ষেপঃ একটি চমৎকার পুস্তক হিসেবে লূক তার পুস্তকটি যীশুর বাবা-মা; তাঁর মাসতুতো ভাই যোহন বাপ্তাইজকের জন্ম; বৈৎলেহমে যোষেফ ও মরিয়মের গমন, যেখানে যীশু একটি যাবপাত্রে জন্মগ্রহণ করেন; এবং মরিয়মের দিক থেকে খ্রীষ্টের বংশতালিকা সম্পর্কিত বিষয়াবলী দিয়ে শুরু করেছেন। জনসম্মুখে যীশুর পরিচর্যা কাজ তাঁর বলা অপব্যয়ী পুত্র, ধনী লোক ও কাঙ্গাল লাসার এবং দয়ালু শমরীয়ের গল্পগুলোর মধ্য দিয়ে তাঁর অনুগ্রহ ও ক্ষমার কথা প্রকাশ করে। তাঁর এই পক্ষপাতহীন ভালবাসার প্রতি বিশ্বাস যখন সব ধরনের মানবিক সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছিল তখন অনেকেই- বিশেষ করে ধর্মীয় নেতারা যীশুর প্রতি নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় ও তাঁর বিরোধিতা করে। যীশুর শত্রুরা যখন ক্রুশে তাঁর মৃত্যু কামনা করছিল, তখন তাঁর অনুসারীরা তাঁর শিষ্য হবার মর্মার্থ উপলব্ধি করে উৎসাহিত হচ্ছিল। সবশেষে যীশু বিশ্বাসঘাতকার সম্মুখীন হলেন, ক্লান্ত হলেন, তাঁকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে ক্রুশারোপিত করা হলো। কিন্তু কবর তাঁকে ধরে রাখতে পারল না! তাঁর পুনরুত্থান হারানোদের খোঁজ করা ও তাদের রক্ষা বা উদ্ধার করার পরিচর্যার বিষয়ে আশ্বাস প্রদান করে।
যোগসূত্রঃ একজন পরজাতীয় হিসেবে পুরাতন নিয়মের প্রতি লূকের দৃষ্টিপাত মথির সুসমাচারের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম পরিলক্ষিত হয়, এবং লূকের বর্ণনার তুলনায় পুরাতন নিয়মের অধিকাংশ প্রসঙ্গ যীশুর দ্বারাই বলা হয়েছে। যীশু শয়তানের আক্রমণ রুখতে বা পরাজিত করার ক্ষেত্রে তাকে উত্তর দিতে “লেখা আছে” (লূক ৪:১-১৩ পদ); তাঁকে প্রতিজ্ঞাত মশীহ হিসেবে পরিচয় দিতে (লূক ৪:১৭-২১ পদ); নিয়ম-কানুন রক্ষার ক্ষেত্রে ফরীশীদের অক্ষমতা ও তাদের যে উদ্ধারকর্তার প্রয়োজন আছে তা স্মরণ করিয়ে দিতে (লূক ১০:২৫-২৮; ১৮:১৮-২৭ পদ); এবং যখন তারা তাঁকে ফাঁদে ফেলতে ও তাঁর সাথে ছলনা করে তখন তাদের শিক্ষার বিষয়ে তাদেরকে হতবুদ্ধি করতে (লূক ২০ অঃ) পুরাতন নিয়মে উল্লেখিত এই কথাগুলো ব্যবহার করেছেন।
বাস্তব বা কার্যকরী প্রয়োগঃ লূক আমাদেরকে আমাদের সহানুভূতিশীল উদ্ধারকর্তার একটি সুন্দর চিত্র বা বর্ণনা প্রদান করেন। যীশু কখনই যারা গরীব ও অভাবী তাদের কাছ থেকে দূরে সরে যান নি; সত্য এই যে, তাঁর পরিচর্যার প্রথম ভাগেই তাদের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। যীশুর সময়কার ইস্রায়েল জাতি তাদের জাতিগত শ্রেণীবিভাগ সম্বন্ধে খুবই সচেতন ছিল। আক্ষরিক অর্থে যারা দুর্বল ও নীচুস্থানে যাদের অবস্থান তারা তাদের জীবনের ভাগ্যের চাকার উন্নয়ন ঘটাতে খুবই শক্তিহীন অবস্থায় ছিল, আর তারাই “ঈশ্বরের রাজ্য তোমাদের সন্নিকট হইল” (লূক ১০:৯ পদ) এই বার্তা গ্রহণে উদারমনা ছিল। আমাদের চারপাশে বসবাসরত লোকদের মধ্যে যারা এই বার্তা বা বাণীটি শোনার জন্য উদগ্রীব আমাদের অবশ্যই তাদের কাছে এটি পৌঁছে দিতে হবে। এমন কি তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধশালী দেশগুলোতেও- বিশেষভাবে আধ্যাত্মিক প্রয়োজন যেখানে অত্যন্ত জরুরীভাবে প্রয়োজন। খ্রীষ্টিয়ানদের অবশ্যই যীশুর উদাহরণ অনুসরণ করতে হবে এবং আত্মিকভাবে যারা দীনহীন ও আকাঙ্খী তাদের কাছে তা পৌঁছে দিতে হবে। ঈশ্বরের রাজ্য সন্নিকট এবং প্রত্যেক দিনই সেই সময় ছোট হয়ে আসছে।
English
লূকলিখিত সুসমাচার