settings icon
share icon
প্রশ্ন

ক্রুশের পথগুলো কী কী এবং আমরা এই পথ থেকে কী শিখতে পারি?

উত্তর


ক্রুশের পথ যা কিনা “ভিয়া ডোলোরোসা” (Via Dolorosa) নামেও পরিচিত – এর অর্থ বলতে প্রভু যীশুর ক্রুশীয় মৃত্যু যাতনার সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে বুঝায়, যে ঘটনাগুলো তাঁর বিশ্বাসীদের মনে এখনও তাদের পাপ সম্পর্কে চেতনা দান করে ও তারা তাদের জীবনকে খ্রীষ্টের শিক্ষানুযায়ী পরিশুদ্ধ করে। ক্রুশের পথ আমাদেরকে প্রভু যীশু খ্রীষ্টের এমন কষ্টভোগের ঘটনাগুলো মনে করিয়ে দেয়, যার মাধ্যমে তিনি তাঁর ঈশ্বরীয় অবস্থান থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে দাসের রূপ ধারণ করে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে সমগ্র মানবজাতির পরিত্রাণের পথ সৃষ্টি করেছিলেন।

প্রভু যীশু ক্রুশীয় মৃত্যুর আগে যে যাতনাভোগ করেছিলেন সেই ঘটনাগুলোর বিবরণ আমরা যেমন বাইবেলে দেখতে পাই, ঠিক সেভাবে ঐতিহাসিকভাবেও এই ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে তাঁর দু:খভোগের ঘটনাগুলো যেভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল; তার বিবরণ নিচে তুলে ধরা হল :

১) প্রভু যীশুকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল।

২) নিজের কাঁধে বহনের জন্য তাকে ক্রুশকাষ্ঠ দেয়া হয়েছিল।

৩) প্রথমবারের মত তিনি ক্রুশ কাঁধে নিয়ে পড়ে যান।

৪) পথে মায়ের সাথে প্রভু যীশুর দেখা হয়।

৫) কুরীণীয় শিমোনকে জোর করে ক্রুশ বহন করানো হয়।

৬) ভেরোনিকা প্রভু যীশুর মুখে লেগে থাকা রক্ত মুছে দেন।

৭) দ্বিতীয়বারের মত তিনি ক্রুশ কাঁধে নিয়ে পড়ে যান।

৮) যিরূশালেমের নারীদের সাথে তাঁর পথিমধ্যে দেখা হয়।

৯) তৃতীয়বারের মত তিনি ক্রুশ কাঁধে নিয়ে পড়ে যান।

১০) প্রভু যীশুর গায়ের কাপড় খুলে নেওয়া হয়।

১১) প্রভু যীশুকে ক্রুশে বিদ্ধ করা হয়।

১২) তিনি ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

১৩) মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ ক্রুশ থেকে নামানো হয়; আর তখন মানুষের বিলাপ পরিলক্ষিত হয়।

১৪) প্রভু যীশুকে করব দেওয়া হয়।

ঐতিহ্যগতভাবে ক্রুশের পথের এই বিবরণীতে উল্লেখিত ৩,৪,৬,৭ ও ৯ নম্বরের ঘটনাগুলো পুরোপুরিভাবে বাইবেলে দেখতে পাওয়া যায় না। এর ফলে “শাস্ত্রীয় ক্রুশের পথ” বিবরণী তুলে ধরার প্রয়োজন হয় । নিচের ১৪টি ধাপে প্রভু যীশুর দুঃখভোগের ‘এই ক্রুশের পথের বিবরণ’ এবং সেগুলো আমাদের জীবনের জন্য কতটা তাৎপর্যপূর্ণ তা তুলে ধরা হলো।

ক্রুশের পথের প্রথম ধাপ : জৈতুন পাহাড়ে প্রভু যীশু খ্রীষ্ট (লূক ২২:৩৯-৪৬ পদ)

প্রভু যীশু তাঁর পিতার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন যেন তাঁকে এই মৃত্যু-যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে না হয়; এ ধরনের প্রার্থনার মধ্য দিয়ে তাঁর মানবীয় স্বভাব ফুটে উঠেছিল (লূক ২২:৩৯-৪৬ পদ)। তিনি কী ধরনের নিদারুন কষ্টভোগ করতে যাচ্ছেন, সে ব্যাপারে তাঁর যে গভীর উপলব্ধি ছিল তা আমরা সহজেই বুঝতে পারি। মানুষের জীবনে এমন কোন সময় আসে, যখন তাকে ঈশ্বরের ইচ্ছা বা নিজের ইচ্ছা -এ দু’টো থেকে যে কোন একটি বেছে নিতে হয়, প্রভু যীশু যেভাবে বেছে নিয়েছিলেন; ঠিক এরকম বেছে নেয়ার সিদ্ধান্তের মাঝেই আমরা পিতা ঈশ্বরের প্রতি কতটুকু বাধ্য ও তাঁর প্রতিশ্রুতি কতটুকু রক্ষা করি, তা সহজেই প্রকাশ পায়। জৈতুন পাহাড়ে প্রভু যীশু খ্রীষ্ট তাঁর জীবনে আসন্ন যাতনাভোগ দূর করার জন্য তাঁর পিতার কাছে প্রার্থনা করলেও তিনি তাঁর নিজের ইচ্ছাকে গুরুত্ব না দিয়ে অনেক কষ্ট সহ্য করা লাগলেও তিনি তাঁর পিতার ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিয়ে তা তিনি মেনে নিলেন। এমনকি ক্রুশের উপর যখন তাঁর প্রাণ যায় যায় অবস্থা, তখনও তিনি পিতার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে কীভাবে প্রত্যেকটা বিষয়ে তাঁকে বিশ্বাস করা যায়, সে বিষয়ে তাঁর এই নিদারুন যাতনার সময়েও আমাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিলেন।

ক্রুশের পথের দ্বিতীয় ধাপ : ঈষ্করিয়োতীয় যিহুদা প্রভু যীশুর সাথে বিশ্বাসঘাকতা করে তাঁকে ধরিয়ে দেয় (লূক ২২: ৪৭-৪৮ পদ)

প্রভু যীশুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে যিহুদা শুধুমাত্র ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ঘৃণার পাত্র-ই হয়নি, যখন কোন খ্রীষ্টবিশ্বাসী প্রলোভনে পা দিয়ে পাপ করে, তখন যিহুদার এই ঘটনাই আমাদের সবার মনে পড়ে যায়। খ্রীষ্টবিশ্বাসীদের জন্য কোন পাপে নিমজ্জিত হওয়ার অর্থ হলো যিনি পাপ থেকে আমাদেরকে মুক্ত করেছেন, তাঁর সাথে প্রকৃত অর্থে বিশ্বাসঘাতকতা করা। যখন আমরা আমাদের ভিতরে থাকা পবিত্র আত্মা কর্তৃক পাপ সম্পর্কে চেতনা দানকে অগ্রাহ্য করে পাপের পথে পা বাড়াই, তখন আমাদের বিশ্বাসঘাতকতা কত গভীরভাবেই না প্রকাশ পায়! (লূক ২২:৪৭-৪৮ পদ)। যিহুদা কয়েক বছর যীশুর সঙ্গে সঙ্গে চলে অনেক শিক্ষা পেয়েছেন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে পবিত্র আত্মার পরিচালনায় তার হৃদয় পরিবর্তন না হওয়ায় সে শয়তানের দ্বারা খুব সহজেই প্রলোভিত হয়ে পাপ করল। বিশ্বাসী হিসেবে আমাদের নিজেদেরকেও পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে, আমরা সত্যিকার অর্থে বিশ্বাসী জীবনযাপন করছি কিনা (২করিন্থীয় ১৩:৫ পদ)।

ক্রুশের পথের তৃতীয় ধাপ : বিচার -সভা প্রভু যীশুকে দোষী সাব্যস্ত করে (লূক:২২:৬৬-৭১ পদ)

সেই সময় সত্তর জন পুরোহিত, ধর্ম শিক্ষক ও একজন প্রধান পুরোহিত নিয়ে গঠিত বিচার-সভায় দাবি করা হলো যে, শাসনকর্তা পিলাত যেন তাঁকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন।

পুরোহিতদের এই বিচার-সভার বিচার থেকে প্রত্যেক খ্রীষ্টবিশ্বাসীদের সতর্ক হতে হবে যেন, আমরা শুধুমাত্র নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি করে শত্রুদেরকে বিচার না করি। বাইবেলীয় জ্ঞান ও মন্ডলীর অনেক উচুঁ পর্যায়ে আমাদের অবস্থান থাকলেও মানুষ হিসেবে আমাদের দুর্বলতা রয়েছে এবং ধার্মিকতার অহংকার থাকলে পৃথিবীর যে কোন ধার্মিক ব্যক্তি যে কোন সময় পতনের সম্মুখীন হতে পারে। যদিও বাইবেল আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যেন আমরা পৃথিবীর শাসনকর্তাদের কর্তৃত্ব মেনে নিই, কিন্তু তারপরেও ঈশ্বরীয় বাক্যের আদেশ সর্বাগ্রে আমাদের জীবনে প্রধান্য দিতে হবে। ঈশ্বরের নিখুঁত পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ; নিজেদেরকে যে কোন পরিস্থিতিতে শান্ত্বনা দান, শিক্ষা দেওয়া এবং পরিচালনা করার ক্ষেত্রে, ঈশ্বরের আমাদেরকে বিশেষ বরদান স্বরূপ যে পবিত্র আত্মা দান করেছেন, সেই পবিত্র আত্মা কখনই চান না যে, আমরা বিচার সভার পুরোহিতদের মত আচরণ প্রকাশ করি। যিহূদী সমাজের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ক্ষমতা পুরোহিতদের নিয়ে গঠিত বিচার-সভার কাছে ন্যস্ত করার কারণে অনেক পুরোহিত ও ধর্ম-শিক্ষকদের মাঝে দুর্নীতি দেখা দিয়েছিল এবং প্রভু যীশুর শিক্ষার মাধ্যমে যখন তাদের এই স্বভাবের জন্য তিরস্কার করা হয়েছিল, তখন তারা তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা ষড়যন্ত্র করে রোমান শানসকর্তাদের মাধ্যমে তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করে তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছিল (লূক ২২:৬৬-৭১ পদ)।

ক্রুশের পথের চতুর্থ ধাপ : পিতর প্রভু যীশুকে অস্বীকার করল (লূক ২২:৫৪-৬২ পদ)

যখন প্রভু যীশু খ্রীষ্টকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তখন ঐ জায়গায় উপস্থিত লোকেরা পিতরকে অভিযোগ করে বলেছিল যে, ‘তুমিও তো যীশুর দলের শিষ্যদের একজন’ (লূক ২২:৫৪-৬২ পদ)। প্রভু যীশুর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী পিতর যীশুকে চেনে না বলে তিনবার অস্বীকার করেছিল। পিতর ছিলেন প্রভু যীশুর প্রিয় ও বিশ্বস্ত শিষ্য, যে যীশুর সাথে সাথে থেকে অনেক অলৌকিক কাজ নিজের চোখে দেখেছে এবং এমনকি সে জলের উপরেও যীশুর নির্দেশে হেঁটেছিল (মথি ১৪:২৯-৩১ পদ)। এছাড়াও পিতর গ্রেফতার হবার ভয়ে যে কোন মানুষ যেমনটা করে থাকে, ঠিক সেইভাবে যীশুকে চেনে না বলে অস্বীকার করেছিল। আজও আমাদের সমাজে যারা যীশুকে হিসেবে বিশ্বাস করে না, তারা খ্রীষ্টবিশ্বাসীদেরকে নানাভাবে গালিগালাজ ও দৈহিকভাবে নির্যাতন করে, এমনকি নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যাও করে। লোকেরা হয়তোবা নিজেদের ধার্মিকতার অহংকারের দৃষ্টিকোণ থেকে রোমীয় সৈন্যদের গ্রেফতারের ভয়ে পিতরের অস্বীকারের ঘটনার বিচার করতে পারে; কিন্তু এখানে প্রশ্ন থেকে যায় যে, বাইবেল বিশ্বাসী কতজন খ্রীষ্টবিশ্বাসী বুকে হাত রেখে বলতে পারবে যে, তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্যাতনের ভয়ে খ্রীষ্টবিশ্বাসের ব্যাপারে ভয়ে চুপ থাকেন নি? বিশ্বাসী হিসেবে এ ধরনের নিরবতার অর্থ হলো মানুষ হিসেবে আমাদের অনেক দুর্বলতা রয়েছে। ঐ সময়ে পিতর পবিত্র আত্মার পরিচালনায় না চলে বরং অবিশ্বাসের পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু এই একই পিতর পঞ্চাশত্তমীর দিনে পবিত্র আত্মায় পূর্ণ হয়ে গর্জনকারী সিংহের মত মানুষের সামনে প্রভুর সুসমাচার উচ্চস্বরে ঘোষণা করেছিলেন (প্রেরিত ২ অধ্যায়)।

ক্রুশের পথের পঞ্চম ধাপ : পন্তীয় পিলাত যীশুর বিচার করেছিল (লূক ২৩:১৩-২৫ পদ)

বর্তমানে আইন অনুযায়ী, যে কোন আদালতেই প্রভু যীশুর বিচার করা অসম্ভব ছিল, কারণ তাঁর বিরুদ্ধে অন্যায়ের কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। পন্তীয় পিলাত যীশুর কোন কাজ-কর্মে কোন অন্যায় পাননি বলে তাঁকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন (লূক ২৩:১৩-২৪ পদ)। কিন্তু বিচার-সভা যীশুর বিরুদ্ধে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করার রায় দিতে চাপ দিয়েছিল এবং এ বিষয়ে তারা জোরালো দাবি তুলেছিল। বিচার সভায় উপস্থিত যারা মোশির আইন-কানুন পালন করতেন, তারা প্রভু যীশুর শিক্ষাকে তাদের ক্ষমতা ধরে থাকার পথে হুমকিস্বরূপ মনে করেছিল। প্রভু যীশু শিক্ষা দিতেন যে, মানুষ তার পাপ থেকে মুক্তি পাবে ঈশ্বরের মহান অনুগ্রহ- দানের মাধ্যমে এবং বিচার- সভার নানান রীতি-নীতিতে বাধ্য হয়ে কোন পরিত্রাণ লাভ হয় না; এ ধরনের শিক্ষা তাদের প্রচলিত রীতি-নীতিকে শুধুমাত্র গুরুত্বহীন করল না বরং তাদের জীবিকা নির্বাহের পথও কঠিন করে তুলল। এমনকি বর্তমানেও পরিত্রাণ যে কারও কর্মের ফল নয় বা নিজের চেষ্টাই অর্জন করা যায় না; এ শিক্ষাটাও খুব বেশি জনপ্রিয় না, মানুষেরা তাদের মানবীয় দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও নিজের চেষ্টায় বা কর্মের মাধ্যমে পরিত্রাণ লাভ করার চেষ্টা করে, যেন তারা একটু হলেও বলতে পারে যে, পরিত্রাণ হল তাদের কাজের ফল। কিন্তু পরিত্রাণ শুধুমাত্র সদাপ্রভু থেকেই হয়, যাাতে এ নিয়ে কেউ গর্ব করতে না পারে (যিশাইয় ৪২:৮ পদ)।

ক্রুশের পথের ৬ষ্ঠ ধাপ : প্রভু যীশুকে চাবুক মারা এবং তাঁর মাথায় কাঁটার মুকুট দেয়া (লূক ২৩:৬৩-৬৫ পদ)

এ অংশে যে সুস্থতা বা আরোগ্য লাভের কথা বলা হয়েছে; তা হল আত্মিকভাবে আরোগ্য লাভ বা পাপ থেকে পরিত্রাণ লাভ। পাপের ক্ষমা পাওয়া এবং ঈশ্বরের কাছে আবার গ্রহণযোগ্য হওয়া-ই হল আত্মিকভাবে আরোগ্য লাভ করা। মাতা মরিয়ম প্রভু যীশুকে জন্ম দেবার প্রায় পাঁচশত বছর আগে ভাববাদী যিশাইয় ভবিষ্যদ্বাণীতে বলেছিলেন যে, যীশুকে আমাদের পাপের জন্য হত হতে হবে এবং তাঁর ক্ষত সকল দ্বারা আমাদের আরোগ্য লাভ হবে (যিশাইয় ৫১:৩-৬ পদ)।

ক্রুশের পথের সপ্তম ধাপ : যীশু তাঁর ক্রুশ তুলে নেন (মার্ক ১৫:২০ পদ)।

প্রভু যীশু যখন তাঁর ক্রুশ তুলে নিলেন, তখন তিনি প্রকৃত অর্থে কোন কাঠের ক্রুশ তুলে নেন নি। সেদিনে উপস্থিত থাকা যীশুর দুঃখ- ভোগের প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই জানত না যে, মানুষের পাপভার তার কাঁধে তুলে নিয়ে আমাদের পক্ষে তাঁর জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে তিনি পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন। মথি ১৬:২৪ পদে, যীশু আমাদেরকে জোর দিয়ে বলেছেন যে, ‘‘কেহ যদি আমার পশ্চাৎ আসিতে ইচ্ছা করে, তবে সে আপনাকে অস্বীকার করুক, আপন ক্রুশ তুলিয়া লউক, এবং আমার পশ্চাৎগামী হউক’’ -তিনি এখানে আমাদের সামনে বেছে নেবার জন্য কোন সুযোগ রাখেননি; কারণ তিনি চান যেন আমরা অবশ্যই এটি করি। ‘‘…….আর যে কেহ আপন ক্রুশ তুলিয়া লইয়া আমার পশ্চাৎ না আইসে, সে আমার যোগ্য নয়’’ (মথি ১০:৩৮ পদ)। আমাদের ক্রুশ তুলে নেবার অর্থ হল আমাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিকে ত্যাগ করে খ্রীষ্টের বাধ্য হয়ে পুরাতন ইচ্ছা বাদ দিয়ে নতুনভাবে খ্রীষ্টের জন্য জীবন যাপন করা (২করিন্থীয় ৫:১৭ পদ)। অন্য অর্থে আরও বলা যায় যে, আমাদের জীবনের সমস্ত ইচ্ছা, আকাঙ্খা পরিত্যাগ করে ঈশ্বরের অধীনে চলার জন্য নিজেকে ঈশ্বরের হাতে সমর্পণ করা। আমাদের নিজেদের ইচ্ছা পূরণ প্রধান লক্ষ্য না হয়ে বরং যদি প্রয়োজন হয়, তবে আমাদের জীবন উৎসর্গ করার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে।

ক্রুশের পথের অষ্টম ধাপ : কুরীনীয় শিমোন যীশুকে ক্রুশ বহন করতে সাহায্য করেছিল (লূক ২৩:২৬ পদ)

কুরীনীয় শিমোনকে পরিস্থিতির স্বীকার বলে মনে করা হয়। খুব সম্ভবত: তিনি যিরূশালেমে নিস্তার-পর্বের উৎসব পালন করতে এসেছিলেন এবং তাঁর সাথে একটু পরে কী ঘটবে সে বিষয়ে একেবারেই জানতেন না। প্রভু যীশু ক্রুশ বহন করে সাহায্য করা কুরীনীয় শিমোনের সম্পর্কে আমরা তেমন কিছু জানি না, কারণ পবিত্র বাইবেলে তাঁর জীবনে এরপর কী ঘটল সে বিষয়ে তেমন বলা নেই (লূক ২৩:২৬ পদ)। রোমীয় সৈন্যরা তাঁকে ক্রুশ বয়ে নেবার কথা বললে হয় তো সে তাঁর জীবনের মায়া করে সৈন্যদের ভয়ে ক্রুশ বহন করেছিল। প্রভু যীশু স্বেচ্ছায় ক্রুশ বহন করেছিলেন, কিন্তু অন্যদিকে কুরীনীয় শিমোনকে যীশুর ক্রুশ বহন করতে বাধ্য করা হয়েছিল। খ্রীষ্টবিশ্বাসী হিসেবে প্রভু যীশুর জন্য স্বেচ্ছায় আমাদেরকে কষ্ট ভোগের পথ বেছে নেয়া উচিত ঠিক যেমনটি সাধু পৌল আমাদেরকে ২তীমথিয় ১:৮ পদে বলেছেন, ‘‘অতএব আমাদের প্রভুর সাক্ষ্যের বিষয়ে, এবং তাঁহার বন্দি যে আমি, আমার বিষয়ে তুমি লজ্জিত হইও না, কিন্তু ঈশ্বরের শক্তি অনুসারে সুসমাচারের সহিত ক্লেশভোগ স্বীকার কর।”

ক্রুশের পথের নবম ধাপ : দুঃখে ভারাক্রান্ত যিরূশালেমের নারীদের সাথে ক্রুশের পথে যীশুর দেখা হওয়া (লূক ২৩:২৭-৩১ পদ)

যীশু তাঁর ক্রুশীয় পথে যাবার সময় যিরূশালেমের দুঃখ-ভারাক্রান্ত নারীদের ও তাঁর শিষ্যদের দেখা পেলেন। তিনি তাদেরকে সতর্ক করে বললেন যে, তারা যেন প্রভু যীশুর জন্য কান্নাকাটি না করে, বরং নিজেদের জন্য ও নিজেদের সন্তানদের জন্য চিন্তিত হয়, কারণ সামনে খারাপ দিন ঘনিয়ে আসছে (লূক ২৩:২৭-৩১ পদ)। তাঁর এই নিদারুন দুঃখ-কষ্টের মাঝেও তিনি তাঁর জন্য চিন্তা না করে বরং অন্যদের জন্য চিন্তা করলেন যেন তারা পাপের মধ্যে বাস না করে নিজেদেরকে রক্ষার জ্ন্য ঈশ্বরের আদেশ পালন করে। এই ধরনের সতর্কতা এখন খ্রীষ্টবিশ্বাসী মানুষদেরও দরকার যেন জাগতিক চিন্তা ও অভিলাষ তাদেরকে ঈশ্বরের পথ থেকে দূরে সরিয়ে না নেয়। যীশু বলেছেন, ‘‘আমার রাজ্য এ জগতের নয়” (যোহন ১৮:৩৬ পদ), তাই স্বর্গের অধিবাসী হিসেবে আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য-ই হবে পৃথিবীস্থ বিষয় না ভেবে স্বর্গস্থ বিষয় চিন্তা করা।

ক্রুশের পথের দশম ধাপ : প্রভু যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হলো (লূক ২৩:৩৩-৪৭ পদ)।

প্রভু যীশু যে কতটা যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন; সেটা প্রায় দুই হাজার বছর পরে এসে আমাদের পক্ষে প্রত্যক্ষদর্শীদের চেয়ে বেশি অনুভব করা সম্ভব না। কারণ রোমীয় সৈন্যদের বাঁধার মুখে পড়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা দূরে দাঁড়িয়ে থেকে প্রভু যীশু খ্রীষ্টের হাতে ও পায়ে পেরেক মেরে তাঁকে যেভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল, এমন নিদারুন কষ্ট উপলদ্ধি করা খুবই কঠিন। এমনকি যীশুর শিষ্যরা ও কাছের মানুষেরাও বুঝে উঠতে পারেনি যে, বাস্তবে সেখানে কী হচ্ছিল। এমনকি তারা এটাও বুঝতে পারেনি যে, ঈশ্বরের মহৎ পরিকল্পনা পূরণের জন্যই প্রভু যীশুকে শত্রুদের এমন নিষ্ঠুর আচরণ সহ্য করতে হয়েছিল যেন মানুষেরা তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে পরিত্রাণ পেতে পারে। আজ আমাদের এই প্রশ্ন করা হচ্ছে যে, ‘‘তবে এমন মহৎ এই পরিত্রাণ অবহেলা করিলে আমরা কি প্রকারে রক্ষা পাইব?” (ইব্রীয় ২:৩ পদ)। ‘‘আর অন্য কাহারও কাছে পরিত্রাণ নাই; কেননা আকাশের নীচে মনুষ্যদের মধ্যে দত্ত এমন আর কোন নাম নাই; যে নামে আমাদিগকে পরিত্রাণ পাইতে হইবে” (প্রেরিত ৪:১২ পদ)।

ক্রুশের পথের একাদশ (১১) ধাপ : ডান পাশের দস্যুকে স্বর্গে যাবার নিশ্চয়তা প্রদান (লূক ২৩:৪০ পদ)

যে দস্যুকে যীশুর সাথে ক্রুশবিদ্ধ করা হচ্ছিল, সে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিল যে, যীশুর এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাঁর সব কিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে না বরং তিনি যে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে মানুষের জন্য এসেছিলেন, তাঁর এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই দুনিয়া একসময় পরিবর্তিত হয়ে এখানে স্বর্গ রাজ্য প্রতিষ্ঠা হবে। এই দস্যুই প্রভুর মহা অনুগ্রহে বিশ্বাসের মাধ্যমে স্বর্গে গিয়েছিল (ইফিষীয় ২:৮-৯ পদ)। প্রভু যীশু এই নিশ্চয়তা তাকে দিয়েছিলেন যে, তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপনের কারণে সেই দস্যু সে দিনই স্বর্গ রাজ্যে যাবে। পরিস্কারভাবে এটা বোঝা যাচ্ছে যে, যারা প্রভু যীশুকে নির্যাতন ও অত্যাচার করেছিল, তারাই পরোক্ষভাবে সেখানকার লোকদেরকে দেখিয়েছিল যে, একজন ব্যক্তি কর্মের দ্বারা নয় বরং সেই দস্যুর মতো বিশ্বাসের মাধ্যমেই ঈশ্বরের পরিত্রাণ লাভ করতে পারে।

ক্রুশের পথে দ্বাদশ (১২) ধাপ : ক্রুশবিদ্ধ যীশু তাঁর মা ও শিষ্যদের সাথে কথা বলেন (লূক ২৩:৪৮-৪৯ পদ)

প্রভু যীশু এমন কষ্টদায়ক মৃত্যুকালীন সময়েও তাঁর মা মরিয়মের দেখাশুনার দায়িত্ব তাঁর প্রিয় শিষ্য যোহনকে দিয়েছিলেন (যোহন ১৯:২৭ পদ)। প্রভু যীশু সমস্ত জীবনব্যাপী এমনকি তাঁর মৃত্যুকালীন সময়েও বাস্তব উদাহরণ দিয়ে দেখালেন যে, যে কোন বিশ্বাসী তার প্রয়োজনের পূর্বে অন্যের প্রয়োজনের বিষয় যেন আগে থেকে চিন্তা করে; আর এভাবে যেন ঈশ্বরের ইচ্ছা মানবজাতির জন্য পূর্ণ হয়। ঈশ্বরের আজ্ঞা অনুযায়ী, এই প্রতিকূলতার পৃথিবীতেও অন্যের জন্য বাস্তবিকভাবে ত্যাগ-স্বীকার করার মধ্য দিয়েই প্রকৃত খ্রীষ্টীয় জীবনের আসল পরিচয় পাওয়া যায়।

ক্রুশের পথের ত্রয়োদশ (১৩) ধাপ : প্রভু যীশু ক্রুশের উপর জীবন দেন (লূক ২৩:৪৪-৪৬ পদ)

প্রভু যীশুর প্রাণত্যাগের সাথে সাথে যিরূশালেমের উপাসনা-ঘরের পর্দা যা কিনা সাধারণ পাপী মানুষ ও পবিত্রদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করত; সেই পর্দা উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দুই ভাগ হয়ে ছিঁড়ে গেল। এই ঘটনা দেখে তৎকালীন যিহূদিরা খুব ভয় পেয়েছিল এবং এই ঘটনার মাধ্যমে যে পুরাতন নিয়মের অবসান হয়ে নতুন নিয়মের সূচনা হল তা অনেকেই বুঝে উঠতে পারল না। পাপের কারণে মানুষকে আর কোন দিন ঈশ্বর থেকে একেবারে আলাদা হয়ে যেতে হবে না; বরং এ ঘটনার ফলে এখন থেকে মানুষেরা প্রার্থনার মাধ্যমে সাহসিকতার সাথে পাপের ক্ষমা পাবার জন্য তাঁর সিংহাসনের সামনে হাজির হতে পারবে। প্রভু যীশুর এ মৃত্যু পাপের প্রতিবন্ধকতা দূর করে মানুষকে অনুগ্রহের মাধ্যমে পরিত্রাণ লাভ করতে সম্ভব করেছে।

ক্রুশের পথের চতুর্দশ (১৪) ধাপ : প্রভু যীশুকে কবর দেয়া হল (লূক ২৩:৫০-৫৪ পদ)

প্রভু যীশু ক্রুশে মারা যাবার পর তাঁকে নামিয়ে অরিমাথিয়া নামক শহরের যোষেফ নামে ব্যক্তির দেয়া কবরে তাঁকে কবরস্থ করা হয় (লূক ২৩:৫০-৫৪ পদ)। এই যোষেফ বিচার সভার একজন সদস্য ছিলেন ‍যিনি প্রভু যীশুর বিচার ও ক্রুশীয় মৃত্যুর পক্ষে রাজি ছিলেন না। অরিমাথিয়ার যোষেফ মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, প্রভু যীশু হচ্ছেন সেই প্রতিজ্ঞাত মশীহ, কিন্তু লোকভয়ে তিনি সবার সামনে সেই বিশ্বাস স্বীকার করতে পারতেন না (যোহন ১৯:৩৮ পদ)। যীশুর মৃত্যুর পর অরিমাথিয়ার যোষেফ গোপনে পিলাতের কাছে গিয়ে যীশুর মৃতদেহকে সুন্দরভাবে কবর দেয়ার জন্য তার কাছ থেকে চেয়ে এনেছিলেন।

প্রভু যীশু খ্রীষ্টের এই মহৎ আত্মোৎসর্গ শুধুমাত্র মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত-ই করেনি; এ ছাড়াও এই মহৎ উৎসর্গের মধ্য দিয়ে অনিবার্য অনন্তকালীন মৃত্যুকে জয় করে মানুষ স্বর্গের অধিবাসী হয়েছে। পাপের কারণে মানুষের জীবনে অনিবার্য মৃত্যু নেমে আসে। আমাদের সৃষ্টিকর্তা ন্যায়পরায়ন হওয়ায় তিনি আমাদের পাপের শাস্তির প্রায়শ্চিত্ত নিজেই করলেন। আমাদের ঈশ্বর এতটাই দয়ালু যে, আমরা যাতে অনন্তকালীন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ না করে স্বর্গরাজ্যের অধিবাসী হতে পারি, এজন্য তিনি তাঁর একজাত পুত্র প্রভু যীশু খ্রীষ্টকে আমাদের জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন (যোহন ৩:১৬ পদ)। প্রভু যীশু তাঁর মৃত্যুকালীন সময়ে যারা তাঁকে মারছিল তাদের জন্য ক্ষমার বাণী উচ্চারণ করে ভালবাসার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন (লূক ২৩:৩৪ পদ)। এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, মানুষের যথেষ্ঠ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অভাবে প্রভু যীশুর বাক্য ও আদেশের প্রতি বাধ্য হওয়া থেকে বিরত থাকে। এ ধরনের অজ্ঞতা থেকে বেরিয়ে না আসতে পারলে তা অনেক মানুষের জন্য আত্মিকভাবে ধ্বংসের মুল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রভু যীশু তাঁর জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে যে পরিত্রাণের ব্যবস্থা সমগ্র মানবজাতির জন্য করেছেন, সেই পরিত্রাণ যদি কোন পাপী মানুষ গ্রহণ না করে, তবে বুঝতে হবে সেই পাপী মানুষের হৃদয়ে এখনও ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যাবার ও পাপের মধ্যে নিমজ্জিত থাকার ইচ্ছা বিরাজমান রয়েছে।

English


বাংলা হোম পেজে ফিরে যান

ক্রুশের পথগুলো কী কী এবং আমরা এই পথ থেকে কী শিখতে পারি?
© Copyright Got Questions Ministries